বাংলাদেশ   শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪  

শিরোনাম

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং আসামের বরাক উপত্যকা : মিলন উদ্দিন লস্কর

নিজস্ব প্রতিবেদক    |    ০৫:৩৩ পিএম, ২০২৪-০৪-২০

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং আসামের বরাক উপত্যকা : মিলন উদ্দিন লস্কর

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে আজ থেকে ৫২ বছর আগে। ১৯৭১ সালে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সমাজের ভূমিকা অবশ্যই  ছিল,তবে প্রতিবেশি হিসেবে ভারত ধাত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিল।মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশের সঙ্গে উত্তর পূর্বের রাজ্য অসম,  ত্রিপুরা, মেঘালয়ের  মানুষও  পাশে দাড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি শরণার্থী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। স্বাধীন যবাংলাদেশ সরকারের তথ্যসূত্র মতে সে সময় শুধু অসমে ৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৫৫ জন শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলেন।এরমধ্যে ২৮টি শরণার্থী শিবিরে ছিলেন ২ লক্ষ ৫৫ হাজার ৬৪২ জন এবং শিবির ছাড়া আশ্রয় নিয়েছিলেন ৯১ হাজার ৯১৩ জন। অনুরূপভাবে ত্রিপুরায় মোট ১৩ লক্ষ ৮১ হাজার ৬৪৯ জন, মেঘালয় রাজ্যে  ৬ লক্ষ ৬৭ হাজার ৯৮৬ জন। আসামের   অবিভক্ত কাছাড় জেলা তথা বরাক উপত্যকার মানুষও এই মুক্তি সংগ্রামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।আর্থিক, নৈতিক এবং কায়িক দিক দিয়েও। এর পেছনে ছিল না কোন স্বার্থ বুদ্ধি। নেহাতই মানবিক দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পেছনে দাড়ানো ভারতীয় ঐতিহ্যের একটি অঙ্গ। সেই ঐতিহ্য  থেকেই বরাকের মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর শতশত বই প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়, কিন্তু  কোন বইয়ে  বরাক উপত্যকার অবদান কি ছিল তা লিপিবদ্ধ হয়নি।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বরাক উপত্যকার অবদান নিয়ে সংক্ষিপ্ত  আলোচনা করছি আমার বক্তব্যে ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জীবনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ  হয়ে এসেছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাইভস্ম থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হবে - এই আনন্দে সারা পৃথিবীর বাঙালি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে বাঙালি জাতিসত্তার যে বিভাজন হয়েছিল, তার মনমানসিকতা চিরতরে বিভাজিত হয়ে যায়নি তা প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। পৃথিবীর একটি দুর্র্ধষ সংগঠিত সৈন্য বাহিনী ছিল পাকিস্তানের, তার বিরুদ্ধে বাঙালির গেরিলা যুদ্ধ একটি অসম লড়াই। এছাড়া সে সময়  ভারত ও রাশিয়া ছাড়া কোন দেশই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না।,'বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি' প্রমাণ করার শপথ নিয়ে বাঙালি লড়ে যাচ্ছিল। 
এই যুদ্ধে  বাংলাদেশের প্রতিবেশি অঞ্চলগুলোর দায়িত্ব ছিল সব থেকে বেশি। স্বভাবত বাংলাদেশের লাগোয়া আসাম রাজ্যের করিমগন্জের ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাত্রাও ছিল অপরিসীম। দীর্ঘ  নয়মাস মুক্তি যুদ্ধের পাশে দাড়িয়েছিল করিমগন্জ। ১৯৬১ সালে বরাকের  ভাষা আন্দোলনে এই শহর যেভাবে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ভারত-বাংলাদেশের সীমা নির্ধারণ করা কুশিয়ারা নদীর দক্ষিণ পার করিমগন্জ শহর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন স্থানীয় সাপ্তাহিক দৃষ্টিপাত পত্রিকার অফিসই বাংলাদেশের ব্যাপারে যোগাযোগ কেন্দ্রের ভূমিকা পালন করে। সম্পাদক ভূপেন্দ্র সিংহ ওরফে মণি সিংহের বিশেষ অবদানের কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। শরণার্থী এবং মুক্তিযুদ্ধে অর্থ ও সামগ্রী দিয়ে রেণু মিয়া চৌধুরী ওরফে আব্দুর রউফ চৌধুরী, প্রহ্লাদ চন্দ্র ঘোষ ওরফে শেফাল ঘোষ,সাংবাদিক বিনোদ সোম,সত্য আচার্য প্রমুখ  বিশেষ অবদান রাখেন।সমাজ বিজ্ঞানী ড.সুজিত চৌধুরী, অধ্যাপক নিশীথ রন্জন দাস, ড. কামালুদ্দিন  আহমদ,আব্দুল বাচিত চৌধুরী প্রমুখ বৌদ্ধিক সমর্থন দিয়ে জনমত গঠনে সহায়তা করেন। 
অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী কীরিমগন্জের সোনাখিরা শরণার্থী শিবির  পরিদর্শন করে পাথারকান্দিতে এক বিরাট জনসভা করেন। সভাশেষে ওই সভার সভাপতি যামিনী মোহন দাস এতই আপ্লুত ওয়ে ওঠেন যে,  তিনি আক্ষরিত অর্থে মতিয়া চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরেন। করিমগন্জের হাই মাদ্রাসায় আওয়ামী লিগপন্থী এবং ভিকমচান্দ হাইস্কুলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পন্থীরা শিবিরভুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাটি লেগে যেত, তখন ন্যাপের নেতা পীর হবিবুর রহমান তা মিটিয়ে দিতেন। করিমগন্জের শিক্ষাবিদ ড. কামালুদ্দিন আহমদ মতিয়া চৌধুরীর সফরসঙ্গী ও উল্লেখিত ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী  ছিলেন।
বর্তমান কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচরেও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে  সহায়তা করার জন্য বেশ কটি গোষ্ঠী  এগিয়ে এসেছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় গোষ্ঠী ছিল ব্যারিস্টার আবুল ফজল গোলাম ওসমানির  নেত্বেত্বে। ওসমানি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা ব্যক্তি ছিলেন। রবীন্দ্র দর্শনের দ্বারা লালিত ও প্রভাবিত।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর মনেপ্রাণে ভীষন আলোড়ন সৃষ্টি  করেছিল। তিনি সংগঠনের শীর্ষে থাকলেও তা পরিচালনার জন্য তাঁর দুটি  শক্ত হাত ছিল  তারামণি চৌধুরী  এবং লেখক সাংবাদিক অতীন দাশ। অর্থের জোগান দিতেন তারামনি চৌধুরী এবং সাংগঠনিক বিষয় দেখাশোনা করতেন অতীন দাশ। ওসমানি সাহেবের সঙ্গে  আরও যারা থাকতেন তারা হলেন সাংবাদিক অমিত নাগ,আক্তার উদ্দিন বড়ভুইয়া ওরফে আক্তু মিয়া, অধ্যাপক যতীন্দ্ররন্জন দে, নামর আলি মোক্তার,প্রেমেন্দ্র মোহন গোস্বামী,ফরিদ আহমদ মজুমদার,নুরুল আলম মজুমদার প্রমুখ।   এদের উদ্যোগেই গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সহায়তা সমিতি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচারের জন্য সমিতি 'বাংলাদেশ' নাম দিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিল।এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন মৌলভিবাজারের আব্দুল মতিন চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। সহযোগিতা করতেন অতীন দাশ।এটি ছাপা হত জননেতা নন্দ কিশোর  সিংহের কো-অপারেটিভ প্রেস থেকে।  সহায়তা সমিতির অস্থায়ী অফিস হয়ে উঠে সাংবাদিক সুনীল দত্তরায়ের অরুনোদয় প্রেস।  জনস্মিলের মালিক সাধন মুখার্জি  এই সমিতিকে একটি ফ্রিজ দিয়েছিলেন ওষুধপত্র রাখার জন্য। সে সময় বাংলাদেশ থেকে যারাই আসতেন তারা অরুনোদয় প্রেসে হাজিরা দিতেন।সিলেটের জমশেদ বকত মজুমদার এবং মুনির বকত মজুমদার সবসময় আসতেন। পরে  বারিস্টার ওসমানির বাড়ির দু'তলায়ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ  নিয়ে প্রায়ই আলোচনা, শলাপরামর্শ হত।ওখানে এসেছেন ফরিদ গাজি,সি আর দত্ত, মতিয়া চৌধুরী,সিলেটের আমিনুর রশিদ চৌধুরী,মেজর জেনারেল ওসমান  থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান পর্যন্ত। জকিগন্জের এম পি  আব্দুল লতিফ, হবিগন্জের রহিম সাহেবরাও আসতেন। এই সময় কলকাতা থেকে পান্নালাল দাশগুপ্ত ও বরুণ দাশগুপ্ত শিলচর আসেন।তারা ওসমানি সাহেবের বাড়িতেই  ছিলেন।পান্নালাল দাশগুপ্ত অর্থ দিয়েও সাহায্য করেন।তার কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে মুক্তিফৌজের নাতানপুর শিবিরে রসদ সামগ্রী পাঠানো হয়। এই গ্রুপের সদস্য কবি-সাংবাদিক অতীন দাশের লেখা একটি কবিতা 'সুরমার স্মৃতি ' কবিতাটি  সেসময় কলকাতা বেতার থেকে দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় প্রায়ই আবৃত্তি করতেন মুক্তি যোদ্ধাদের প্রেরণা যুগাতে।  মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পরই ওসমানির নেতৃত্বে একটি টিম প্রথম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। এই টিমে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন লেখক ভাষা গবেষক ইমাদ উদ্দিন বুলবুল,তারামণি চৌধুরী, নুরুল আলম মজুমদার সহ আরও কয়েকজন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল  মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি অ্যম্বেসেডার কার নিয়ে তারা  বাংলাদেশ রওয়ানা হন। করিমগন্জের চর বাজারের দিকে ডিঙ্গি নৌকো দিয়ে কুশিয়ারা নদী  পার হয়ে তারা হবিগন্জ যান। সেখানকার মানুষ এবং হবিগন্জ থানায় গিয়ে কর্তব্যরত অফিসার সহ কয়েকজন পুলিশের সঙ্গে দেখা করেন।তখন  থানার ওসি ছিলেন নোয়াখালি জেলার। এই প্রতিনিধিদল আশ্বাস দিয়ে আসেন মুক্তি যুদ্ধে আমরা আপনাদের পাশ থাকবো। 
১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনে শিলচর পুরসভার যেভাবে একটি উজ্জল ভূমিকা ছিল,সেভাবে ১৯৭১ সালে  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এই পুরসভা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।তবে পুরসভার নামে নয় ' বাংলাদেশ সহায়তা সমিতি'র ছত্রছায়ায়।এই সংগঠনের প্রধান ছিলেন শিলচর পুরসভার ওই সময়ের চেয়ারম্যান দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত। আহ্বায়ক ছিলেন তারাপদ ভট্টাচার্য। এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন উপ-পুরপতি মৃণালকান্তি দত্তবিশ্বাস ওরফে পলু বিশ্বাস,বিপ্লবী অনন্ত দেব,সুভাষ চৌধুরী, ড. দিলীপ দে প্রমুখ।তাঁদের  ভূমিকা ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল। বাংলাদেশের অগ্নিকন্যা ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টির মতিয়া চৌধুরী  তাঁর আগুন ঝরানো বক্তৃতা দিয়ে বরাকের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি  উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।শিলচর গান্ধীবাগ ময়দানে তাঁর  বক্তৃতা শোনার জন্য এত বিশাল জমায়েত হয়েছিল যার ফলে পাশের পার্করোডে গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। শিলচরে মতিয়া চৌধুরী প্রায় পনেরো দিন ছিলেন।এই সময়ে তিনি কাঠাল বাগান,কাশিপুর, জালালপর ইত্যাদি স্থানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতেন। মতিয়া চৌধুরী কয়েকদিন বিপ্লবী অনন্ত দেবের মেহেরপুরের বাসায় ছিলেন।পুরপতি দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্তের নেতৃত্বাধীন  সহায়তা সমিতি মুক্তিযুদ্ধের  সাহায্যার্থে কলকাতা থেকে শিল্পী মান্না দেকে এনে অনুষ্ঠান করে সেই  অর্থ  মুক্তিযুদ্ধের জন্য ব্যয় করেছিলেন।এছাড়াও সিলেটের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য (বাবুল) এর উদ্যোগে শিলচর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের সহযোগিতায় এখানে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আরতি ধর,হিমাংশু বিশ্বাস, বিদিতলাল দাসরাও অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধচলাকালিন সময়ে ওই সমিতির সদস্যরা তারাপদ ভট্টাচার্যের নেতৃেত্বে ত্রাণ সাহায্য নিয়ে বিয়ানি বাজার পর্যন্ত গিয়েছিলেন।অবশ্য যাবার সময় তারা বদরপুরে বাংলাদেশ  লিয়াসো অফিসার আব্দুল আজিজের কাছ থেকে পাস নিয়ে গিয়েছিলেন।মুক্তিযুদ্ধে অসম সরকারে ই এ সি অর্থাৎ এক্সট্রা এসিসটেন্ট কমিশনার আশিস দত্তের অবদানের কথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন শিলচর রেডক্রস  সোসাইটি চিকিৎসা ও ওষুধপত্র দিয়ে যথেষ্ট  সহায়তা করেছিল।তখন রেডক্রসের সম্পাদক ছিলেন ডাঃ নলিনাক্ষ চৌধুরী।রেডক্রস সোসাইটির সক্রিয় সদস্য ডাঃ ধরনীনাথ চক্রবর্তী, পরাণ চক্রবর্তী, মৃণালকান্তি দত্ত বিশ্বাস  ওরফে পলু বিশ্বাসরা সক্রিয় ছিলেন।মুক্তিযুদ্ধের  সময় রেডক্রসের কাজকর্মের কয়েকটি ফটোগ্রাফ ও পেপার কাটিং নলিনাক্ষ  চৌধুরী তনয় নিলোৎপল চৌধুরী  বছর কয়েক আগে সিলেটের মতিন উদ্দিন চৌধুরী জাদুঘরে হস্তান্তর করেন।  শিলচর মার্চেন্ট এসোসিয়েশন অর্থ ও খাদ্য সামগ্রী দিয়ে দীর্ঘ নয়মাস মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছিল। এই সংস্থার নেতৃত্বে ছিলেন সম্পাদক অরবিন্দ দত্তচৌধুরী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অভিভক্ত কাছাড় জেলা ছাত্র পরিষদও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।সে সময়ের ছাত্র পরিষদের সক্রিয় কর্মকর্তারা ছিলেন সুনীল রায়,মনিলাল দেব,হরি কুমার সিনহা,মিহিরলাল রায়,দয়াদ্র্র পাল চৌধুরী, সুদীপ দত্ত,নবেন্দু শেখর নাথ,অরুণ ভট্টাচার্য, জহুরুল হোসেন  বড়লস্কর,শংকর রায় চৌধুরী, এ কে সাদ উদ্দিন  লস্কর প্রমুখ।এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং শরণার্থীদের অনেক সাহায্য করেছেন।
যেহেতু,মুক্তিযুদ্ধ  চলাকালীন সে সময়ের বরাক উপত্যকার একাংশ মুসলিম সম্প্রদায়   'পূর্ব পাকিস্তান ' ভেঙে যাওয়াকে মেনে নিতে চায়নি,তাই তাদের  বোঝানোর প্রয়োজন ছিল।  তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করার জন্য স্থানেস্থানে সহায়ক সমিতি গড়ে উঠেছিল।তখন শিলচর কাছাড় কলেজকে কেন্দ্র  করে গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ সহায়ক কমিটি। সভাপতি শংকর রায়চৌধুরী, সহ-সভাপতি লুৎফুর রহমান, সম্পাদক  ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, সহ-সম্পাদক আব্দুল রকিব। এই কমিটিতে আরও ২৩ জন সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে এই সমিতি   শিলচরের আজাদ প্রেস থেকে একটি আবেদনপত্র ছাপা করে বরাক উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে প্রচার করা হয়েছিল। এই সহায়ক সমিতি মূলত বরাক উপত্যকার গ্রামগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকার্য চালাত এবং শিলচরে গোলাম ওসমানির নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর এবং বদরপুরের বাংলাদেশ লিয়াসন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। সে সময় স্থানীয় সংবাদপত্রগুলিও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামী হুরমত আলি বড়লস্কর সম্পাদিত সাপ্তাহিক আজাদ পত্রিকা এবং সুনীল দত্তরায় সম্পাদিত অরুণোদয় পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও  মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক খবরাখবর  গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করত। এ সময় বরাক উপত্যকার লোক কবিরাও  উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।লোক কবিরা শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থন এবং মুক্তিযুদ্ধাদের উৎসাহ জানিয়ে কবিগান লিখে হাট-বাজারে দু'তারা সহযোগে পরিবেশন করে মুক্তি যুদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছিলেন।এ রকম এক পল্লীকবি অমর চাঁদ আচার্যের লেখা একটি কবিগান' জয় বাংলার কবিতা' আমি সংগ্রহ  করতে সক্ষম হয়েছি। 
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সমগ্র বরাক উপত্যকা প্রশাসনিকভাবে কাছাড় জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। জেলাশাসক ছিলেন কে এস রাও। সরকারি তথ্য মতে ওই সময়, কাছাড় জেলায় পূর্ব পাকিস্তান  থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য শিলকুড়ি,হরিণছড়া,চন্দ্রনাথপুর, চরগোলা,সোনাখিরা, দাসগ্রাম ও লক্ষীনগরে আশ্রয় শিবির খোলা হয়েছিল। এই শিবিরগুলি থেকেও  মুক্তিযুদ্ধা রিক্রুট করার জন্য  দায়িত্বে ছিলেন মূলত সিলেটের মুক্তিযুদ্ধা সংগঠক নির্মল বিকাশ দাসগুপ্ত,প্রবীর কুমার সিনহা,প্রণব কুমার সিনহা, বন্ধুগোপাল দাস,বিদিত চন্দ্র গোস্বামী প্রমুখ।আর সমগ্র বরাক অঞ্চলের জন্য দেওয়ান ফরিদ গাজি। তিনি ছিলেন ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের  বেসামরিক উপদেষ্টা ও উত্তরপূর্ব রণাঙ্গনের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিল চেয়ারম্যান।এই সেক্টরের সামরিক দায়িত্বে ছিলেন সিলেটের আরেক কৃতি সন্তান ও পাকিস্তান  সেনা বাহিনীর পদত্যাগকারী মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ( সি আর দত্ত) । মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক প্রণব কুমার সিনহা পরবর্তীতে সিলেট এম সি কলেজের অধ্যক্ষ  হয়েছিলেন। 
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে তিনজন মুক্তিযুদ্ধা রণাঙ্গনে মারা গেলে তাদের শিলচর মধুরবন্দস্থিত সরকারি গোরস্থানের উত্তর দিকে দাফন  করা হয়েছিল।এর মধ্যে একজন ছিলেন বাংলাদেশের কুলাউড়ার জুরি এলাকার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বরাক উপত্যকায় একমাত্র লিয়াসন অফিস বদরপুর চৌমাথায় গড়ে উঠেছিল।বিয়ানি বাজারের আত্মসমর্পণকারী আওয়ামিলিগ নেতা মোঃ আব্দুল আজিজ ছিলেন লিয়াসন অফিসার। কাটিগড়ার প্রোগ্রেসিভ অ্যাকাডেমির সদস্যরা তাকে  দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করতেন। ২০১২ সালে ভাষা গবেষক ও প্রোগ্রেসিভ একাডেমির সদস্য ইমাদ উদ্দিন  বুলবুল বিয়ানি বাজারের বাড়িতে গিয়ে একবার তাঁর সাথে দেখাও করেছিলেন।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালিন বরাক উপত্যকার মানুষের ত্যাগ ও তিতিক্ষার আরও অনেক কাহিনী রয়েছে।করিমগন্জের সঙ্গীতশিল্পী খালেক চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমাবেশে তাঁর স্বরচিত গান গেয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করতেন।কালাইন থানার ধূমকর গ্রামের আবু বক্কর বিভিন্ন বাজারে গিয়ে খান সেনাদের লোমহর্ষক নির্যাতনের কবিগান শুনিয়ে মানুষকে যুদ্ধের সমর্থনে নিয়ে আসতে প্রচুর সাহায্য  করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিলচরের গান্ধী  শান্তি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের খাদ্য সামগ্রী ছাড়াও বস্ত্র বিতরণ করা হয়েছিল।
ওই সময়ে  বরাক উপত্যকার বেশিরভাগ স্কুল-কলেজ শরণার্থীতে গিজগিজ করছিল, তাই ১৯৭১ সালে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনায় ব্যাঘাত হয়েছিল।সেই  সময়ে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী সহ যুবকরা প্রায় নয়মাস আক্ষরিক অর্থে প্রায় বিনিদ্র  রাত কাটিয়েছিল -উৎসাহ উদ্বেগ উৎকন্ঠা আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য - সব কিছু নিয়ে। সেই উন্মাদনা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাইকে গ্রাস করেছিল। কেউ পরিশ্রমকে পরিশ্রম বলে ভাবেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হোক,ধর্মনিরপেক্ষ রাস্ট্রে পরিণত হোক,এই ছিল তাদের একমাত্র প্রত্যাশা। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বরাকবাসীর অবদানের কথা ওই দেশের সরকারের কাছে কোন গুরুত্বই পায়নি। 
এই উপত্যকার যারা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দীর্ঘ নয়মাস মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল, তারা অনেকেই  প্রয়াত কিংবা বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তারা কেউ বাংলাদেশের জনগনের কাছ থেকে এর কোন প্রতিদান আশা করে নি। আজও করছে না। যদিও তিনজনকে স্বাধীনতার ৫০ পূর্তি উপলক্ষে ইতিমধ্যে  বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি জানিয়েছে, তা প্রতীকী মাত্র। বাংলাদেশ,যদি সত্যিকার অর্থে কোনদিন ধর্মনিরপেক্ষ রাস্ট্রে পরিণত হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত হয়ে বিশ্বের বাঙালিদের আশা - আকাঙ্খা পূরণে সমর্থ  হয়, তবেই জানবো বরাকের মানুষের পরিশ্রম  সার্থক হয়েছে।
 

রিটেলেড নিউজ

বাংলা অ্যাকাডেমিতে ভাষাশহিদ অহিউল্লাহর মুরাল স্থাপনের আবেদন

বাংলা অ্যাকাডেমিতে ভাষাশহিদ অহিউল্লাহর মুরাল স্থাপনের আবেদন

আমাদের বাংলা ডেস্ক : :   নিজস্ব প্রতিবেদক বাংলা অ্যাকাডেমি চত্বরে ভাষাশহিদ অহি উল্লাহ'র মুরাল স্থাপনের আবেদন করেছে...বিস্তারিত


এমআইএসটিতে ৬ষ্ঠ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধন

এমআইএসটিতে ৬ষ্ঠ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধন

আমাদের বাংলা ডেস্ক : :   নিজস্ব প্রতিবেদক মিরপুর সেনানিবাসে মিলিটারী ইন্সটিটিউট অব সাইন্স এ্যান্ড টেকনোলজী (এমআইএস...বিস্তারিত


৭২ বছর পর আজিমপুরে ভাষাশহিদ রফিকের কবর চিহ্নিত

৭২ বছর পর আজিমপুরে ভাষাশহিদ রফিকের কবর চিহ্নিত

আমাদের বাংলা ডেস্ক : : সাজেদা হক ৭২ বছর পর ভাষাশহিদ রফিকউদ্দিন আহমদের কবরটি চিহ্নিত করা হয়েছে।১৬ বৈশাখ ১৪৩১(২৯ এপ্রিল ২...বিস্তারিত


জাফলংয়ের বল্লাঘাট খুবলে খাচ্ছে ফিরোজ-ফয়জুল সিন্ডিকেট: চলছে নীরব চাঁদাবাজি

জাফলংয়ের বল্লাঘাট খুবলে খাচ্ছে ফিরোজ-ফয়জুল সিন্ডিকেট: চলছে নীরব চাঁদাবাজি

আমাদের বাংলা ডেস্ক : : জৈন্তাপুর প্রতিনিধি: সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং বল্লাঘাট ঝুম্পার নামক এলাকা থেকে প্রত...বিস্তারিত


আনোয়ারাবাসী ঐক্য জোটের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

আনোয়ারাবাসী ঐক্য জোটের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

চট্টগ্রাম ব্যুরো : : আনোয়ারাবাসী ঐক্য জোটের ব্যানারে আনোয়ারার সার্বিক বিষয় নিয়ে সুশীলসমাজের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হ...বিস্তারিত


কোরবানিতে এক কোটি ৩০ লাখ গবাদিপশুর জোগান দেওয়া হবে: মন্ত্রী

কোরবানিতে এক কোটি ৩০ লাখ গবাদিপশুর জোগান দেওয়া হবে: মন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক : আগামী কোরবানির সময় এক কোটি ৩০ লাখ গবাদিপশু জোগান নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন মৎস‌্য ও প্রাণিসম...বিস্তারিত



সর্বপঠিত খবর

মেঘনা নামে কুমিল্লা ও পদ্মা নামে ফরিদপুর বিভাগ হবে: প্রধানমন্ত্রী

মেঘনা নামে কুমিল্লা ও পদ্মা নামে ফরিদপুর বিভাগ হবে: প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক :  মেঘনা নদীর নামে কুমিল্লা ও পদ্মা নদীর নামে ফরিদপুর বিভাগ হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হ...বিস্তারিত


রাজবাড়ীর পাংশায় ডি‌বির অ‌ভিযা‌নে অস্ত্র,গু‌লি, চাপা‌তি, রামদা, ‌মোটর সাইকেলসহ ১ আসামী‌ গ্রেফতার

রাজবাড়ীর পাংশায় ডি‌বির অ‌ভিযা‌নে অস্ত্র,গু‌লি, চাপা‌তি, রামদা, ‌মোটর সাইকেলসহ ১ আসামী‌ গ্রেফতার

রাজবাড়ী প্রতিনিধি : :                              রাজবাড়ীর পাংশায় ডি‌বির অ‌ভিযা‌নে ওয়ানশুটারগান,গু‌লি,...বিস্তারিত



সর্বশেষ খবর